বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল একদিকে সাফল্যের গল্প লিখছে, অন্যদিকে বারবার বিতর্কের মুখোমুখি হচ্ছে। ২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত দলটি। বাজেট সংকটের অজুহাতে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ করতে পাঠায়নি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), যা নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা হয়। এর পাশাপাশি বেতন কাঠামোতে স্বচ্ছতা এবং বৃদ্ধির দাবিতে নারী ফুটবলারদের অনুশীলন বর্জনের ঘটনাও ঘটে।
দুই বছর পরও দলটি দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এগিয়ে যাওয়ার বদলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলারের অধীনে কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড় অনুশীলন করতে চান না। ফেডারেশন যদি বাটলারকে বহাল রাখে, তাহলে তারা ফুটবল ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন, যা পুরো দলকে সংকটে ফেলেছে।
একটি ফুটবল দলের কৌশল নির্ধারণ ও পরিচালনার মূল দায়িত্ব কোচের হলেও ফেডারেশনের ওপরও বড় দায়িত্ব থাকে। নারী ফুটবলের বর্তমান সংকটের পেছনে বাফুফের ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। পিটার বাটলারের প্রতি খেলোয়াড়দের অসন্তোষ নতুন কিছু নয়। সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগেই এই অসন্তোষের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু খেলোয়াড়দের উদ্বেগ ও অভিযোগ আমলে না নিয়ে বাফুফে তাকে আরও দুই বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছে।
এমনকি মাঠে ফুটবলারদের পারফরম্যান্সের ওপর ভর করেই গত কয়েক বছর ধরে বাফুফের নারী ফুটবলের সাফল্য টিকে আছে। অথচ তাদের মতামত গুরুত্ব না দিয়ে কোচ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি ফেডারেশনের অবহেলার একটি বড় উদাহরণ।
নারী ফুটবলের ম্যানেজার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করা আমিরুল ইসলাম বাবু খেলোয়াড় ও কোচের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করার কথা। কিন্তু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। ফলে খেলোয়াড়দের অভিযোগ যথাযথভাবে পর্যালোচনা বা রিপোর্ট করা হয়নি।
ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে যোগ দেন এলিট একাডেমির প্রধান হিসেবে। পরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য তাকে প্রধান কোচ করা হয়। কিন্তু দলের ভেতরে সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে তার সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না।
একজন কোচের উচিত তার দলের প্রতি সম্মান বজায় রাখা, যা বাটলার অনেক ক্ষেত্রে করতে পারেননি। টুর্নামেন্ট চলাকালে তিনি গণমাধ্যমে খেলোয়াড়দের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন, যা কোড অব কন্ডাক্টের লঙ্ঘন।
তবে শুধু কোচ নয়, কিছু ফুটবলারও শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। সিনিয়র খেলোয়াড়দের মধ্যে কেউ কেউ ফিটনেস ও পারফরম্যান্সজনিত কারণে দলে জায়গা ধরে রাখতে পারছেন না। কোচের কড়া তদারকিতে তারা অস্বস্তিতে পড়েছেন এবং তা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।
বাংলাদেশের নারী ফুটবল গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও কোচ-খেলোয়াড় দ্বন্দ্বের কারণে দলটি পিছিয়ে পড়তে পারে। নারী ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে ফেডারেশনকে খেলোয়াড়দের মতামত গুরুত্ব দিতে হবে, কোচকেও খেলোয়াড়দের প্রতি সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে, এবং খেলোয়াড়দেরও শৃঙ্খলা বজায় রেখে পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিজেদের উন্নতিতে মনোযোগ দিতে হবে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নয়তো সাম্প্রতিক সাফল্য কেবল অতীতের গল্প হয়েই থাকবে।