বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সাধারণত খেলোয়াড়, কোচ, সংগঠক, কিংবা বিচারকদের নিয়েই আলোচনা হয়। তবে জেলার খেলাধুলার সার্বিক দায়িত্বে যারা থাকেন, সেই জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তাদের নিয়ে খুব একটা কথা বলা হয় না। অথচ তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১০ জেলার ক্রীড়া দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ৯ জন নারী ক্রীড়া কর্মকর্তা, যা নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে নেতৃত্বের একটি দৃষ্টান্ত।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ক্রীড়া পরিদপ্তরের আওতায় জেলা ক্রীড়া অফিসগুলো পরিচালিত হয়। এসব অফিসের প্রধান হলেন ক্রীড়া কর্মকর্তা, যিনি জেলা পর্যায়ে ক্রীড়া কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেন। ১৯৭৬ সালে ক্রীড়া পরিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হলেও ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোনো নারী ক্রীড়া কর্মকর্তা ছিলেন না। প্রথমবারের মতো ফারজানা আক্তার সাথী এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে ২০১৯ সালে আরও আটজন নারী ক্রীড়া কর্মকর্তা নিয়োগ পান। বর্তমানে ক্রীড়া পরিদপ্তরের ৫২ জন কর্মকর্তার মধ্যে ৯ জনই নারী।
নারীরা প্রশাসনিক ও অন্যান্য সরকারি পদে দায়িত্ব পেলে তা আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে, কিন্তু ক্রীড়া কর্মকর্তাদের অবদান তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত হয়। দেশের প্রথম নারী ক্রীড়া কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার সাথী বলেন, “একটি জেলার যেকোনো ক্রীড়া কার্যক্রমে ক্রীড়া কর্মকর্তার ভূমিকা থাকে। বাস্তবিক অর্থে, ক্রীড়া কর্মকর্তা ছাড়া জেলার খেলাধুলা আয়োজন প্রায় অসম্ভব। তবে এখনো আমাদের তেমন স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।”
নারী ক্রীড়া কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। ক্রীড়া অফিসার হতে হলে বিপিএড (শারীরিক শিক্ষার বিশেষায়িত ডিগ্রি) ডিগ্রি বাধ্যতামূলক হওয়ায় তাদের বেশিরভাগই একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় দক্ষতা অর্জন করেছেন।
সরকারি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী ক্রীড়া কর্মকর্তাদের বদলি হতে হয়, যা অনেক সময় নারী কর্মকর্তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া, পরিবারের থেকে দূরে থাকা—এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মানিকগঞ্জের জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা ফেরদৌসী আক্তার বন্যা বলেন, “নারী হয়ে নতুন জায়গায় দায়িত্ব নেওয়া কঠিন, তবে পরিবার ও সহকর্মীদের সমর্থনে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।”
বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার দ্বৈত দায়িত্ব পালন করছেন ফারজানা আক্তার সাথী। তার মতে, একসঙ্গে দুটি জেলার দায়িত্ব সামলানো কষ্টসাধ্য হলেও তিনি তা সফলভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছেন।
নারী ক্রীড়া কর্মকর্তাদের কাজ করতে হয় অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও। বেশিরভাগ জেলা ক্রীড়া অফিস এখনো ভাড়া ভবনে পরিচালিত হয়, পর্যাপ্ত লোকবল নেই, এমনকি যানবাহন সুবিধাও অপ্রতুল। মুন্সিগঞ্জের ক্রীড়া কর্মকর্তা খাদিজা পারভীন বলেন, “আমরা শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করি। ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে পারবে না যে নারী কর্মকর্তা থাকায় কোনো কাজ হয়নি, বরং আমরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করি।”
বর্তমানে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তারা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য সচিবের দায়িত্বও পালন করছেন। এতে তাদের দায়িত্ব আরও বেড়েছে, তবে তারা এই নতুন চ্যালেঞ্জকেও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন।
৯ নারী জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা যারা দায়িত্ব পালন করছেন:
আফরিন আক্তার মনি (জামালপুর)
ফেরদৌসী আক্তার বন্যা (মানিকগঞ্জ)
খাদিজা পারভীন (মুন্সিগঞ্জ)
অনামিকা দাস (মাগুরা)
সেতু আক্তার (নেত্রকোণা)
ফারজানা আক্তার সাথী (গাজীপুর, অতিরিক্ত দায়িত্ব নারায়ণগঞ্জ)
ফারজানা আক্তার মুমু (নরসিংদী)
হীরা আক্তার (ফেনী)
মাহমুদা আক্তার (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
নারীরা ক্রীড়া প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন, যা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। তাদের এই অগ্রযাত্রা আগামী দিনে আরও নারীকে এই পেশায় আসতে অনুপ্রাণিত করবে।